বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে অতীতের সকল ভেদাভেদ ভুলে জাতিকে এগিয়ে নিতে জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন। ৫০ বছরে কে ভালো করেছে আর কে মন্দ করেছে তা নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। মনে রাখতে হবে জাতি বিভক্ত হলে পরাজিত শক্তিই জয়ী হয়। দেশের স্বাধীনতা এবং মানুষের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে আনতে যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
তিনি রোববার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ আয়োজিত স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে এক আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমীর নুরুল ইসলাম বুলবুলের সভাপতিত্বে ভার্চুয়াল এই আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অবঃ) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম (বীর প্রতিক), জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান। কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদের পরিচালনায় আরও বক্তব্য রাখেন, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের নায়েবে আমীর মন্জুরুল ইসলাম ভূঁইয়া, ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি সালাহউদ্দিন আইঊবী। আরও উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সহঃ সেক্রেটারি যথাক্রমে এডভোকেট ড. হেলাল উদ্দিন, মু. দেলওয়ার হোসাইন, মু. আবদুল জব্বার, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের কর্মপরিষদ সদস্য আব্দুস সবুর ফকির প্রমুখ।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, স্বাধীনতা আল্লাহর এক বিশেষ নিয়ামত। এজন্য তিনি মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করেন। তিনি মহান স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করেন। একইসাথে স্মরণ করেন স্বাধীনতার ঘোষনা যিনি সাধারন মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন সেই শহীদ জিয়াউর রহমানকেও। এসময় তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত শহীদ এবং বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবারের প্রতি সম্মান জানান।
তিনি স্বাধীনতার এই ৫০ বছরে যারা দেশ পরিচালনা করেছেন তাদের প্রতিও তিনি কৃতজ্ঞতা জানান। অতীতে যারা ভালো করেছে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ আর যারা খারাপ করেছে তাদের তিনি ক্ষমার কথা বলেন। তিনি বলেন অতীত নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আগামীর প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখাতে হবে। বাংলাদেশ সৃষ্টির সুচনালগ্ন থেকেই নানা চক্রান্ত চলছে। জাতিকে নানাভাবে বিভক্ত করা হয়েছে। দরকার ছিল জাতীয় ঐক্যের কিন্তু তা হয়নি। মনে রাখতে হবে জাতির মধ্যে কোন বিভক্তি সৃষ্টি করা যাবে না। যদি জাতির মধ্যে স্বাধীনতার ৫০ বছরেও বিভক্তি থাকে তাহলে আমরা আরও পিছিয়ে পরবো। আসুন জাতির এ সংকটে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলি। যখনই গোটাজাতি ঐক্যবন্ধ হয়েছে তখন অপশক্তি পরাজিত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার অবস্থা আজ ভয়াবহ। আজ মেধার মূল্যায়ন হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ব্যক্তির বিরুদ্ধে আজ দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত তাহলে ছাত্ররা তাদের কাছ থেকে আর কি নৈতিকতা শিখবে। ছাত্রদের হাতে খাত কলম থাকার কথা কিন্তু তাদের হাতে আজ মাদক ও অস্ত্র। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আজ চর দখলের মত রাজত্ব চলছে। তাদের হাতে শুধুমাত্র ভিন্ন মতের ছাত্ররাই নয় নিজেদের দলের ছাত্ররাও খুন হচ্ছে। বিপুল সংখ্যাক ছাত্র আজ তাদের ছাত্রত্ব হারাতে বসেছে। তাহলে এখান থেকে কিভাবে মেধাবীরা বের হবে। দায়িত্বশীলরা আজ ব্যর্থ হয়েছে। মেরুদন্ড দুর্বল হলে জাতি দাঁড়াতে পারে না। করোনার কারণে দীর্ঘ এক বছর সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে অথচ বিশ্বের অনেক দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে। আমরা এখনও বিকল্প কোন ব্যবস্থা চালু করতে পারিনি ফলে জাতি আজ মেধাশূণ্য হয়ে চলেছে।
তিনি আরও বলেন, সরকারের দায়িত্ব হলো দেশের জনগনের শান্তি, ইজ্জত-সম্মান ও জান-মালের নিরাপত্তা দেয়া কিন্তু সরকারের লোকেরাই তা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। আজ সবার মুখেই তালা লাগানো। মুখ খুলে কথা বললেই মামলা। আমরা বাক স্বাধীনতার জন্য ১৯৭১ সাথে যুদ্ধ করেছিলাম। কিন্তু আজ তা নেই। এটি একটি স্বাধীন দেশের বৈশিষ্ট হতে পারে না। বিরোধী মত দমনের ধারনা বাদ দিতে হবে। নাগরিকের হাতে ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে এটা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। তিনি শাল্লার ঘটনার উদারহন টেনে বলেন, ঘটনা ঘটার সাথে সাথেই একটি দলের উপর দায় চাপিয়ে দেয়া হলো। কিছু ঘটলেই ইসলামী দলগুলোর উপর চাপিয়ে দেয়া তাদের রোগে পরিনত হয়েছে। পরে দেখা গেলো এই ঘটনার সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই বরং স্থানীয় যুবলীগ নেতার নেতৃত্বে এ ঘটনা ঘটেছে এবং সে গ্রেফতারও হয়েছে। যারা এদেশে জম্ম নিয়েছে সবাই দেশের গর্বিত নাগরিক। দেশের স্বার্থ রক্ষায় আমাদের সকলকে অতন্দ্র প্রহরীর ভুমিকা পালন করতে হবে।
মেজর জেনারেল (অবঃ) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম বীর প্রতিক বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ ছিল ২০ বছর ৬ মাস, বিএনপি ছিল সাড়ে ১৪ বছর, জাতীয় পার্টি ছিল ৫ বছর আর বাকি সময় স্বৈরাচার সরকার। এসময় সবাই কম বেশি দেশের উন্নয়নে কাজ করেছেন। কিন্তু এখন অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে দেশের সব উন্নয়ন কাজ শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ একাই করেছে। এটা কোনভাবেই সঠিক নয়। গত ৫০ বছরে দেশে উন্নয়ন হয়েছে, ব্রীজ বেড়েছে, জিডিপি বেড়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ বেড়েছে আর তার সাথে বেড়েছে দেশের দুর্নীতিও। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়েছে দেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা দেশের জন্য যুদ্ধ করলেও দেশ চালানোর সময় তারা পায়নি। দেশের জন্য আমরা যুদ্ধ করেছি আমরা চাই নতুন প্রজম্মকে এগিয়ে নিয়ে আসতে। জাতির মধ্যে আর কোন বিভেদ নয় এখন থেকে আমাদের নতুন করে শুরু করতে হবে। যারা স্বাধীনতার পরে জম্ম নিয়েছে তারা আবার কিভাবে স্বাধীনতা বিরোধী হতে পারে। এধরনের বিভক্তি আমাদের বাদ দিতে হবে।
মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের তিনটি মূলমন্ত্র সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার আজও অর্জিত হয়নি। স্বাধীনতার ঘোষনাপত্রের কোথাও ধর্মনিরপেক্ষ এবং সমাজতন্ত্রের কথা উল্লেখ নেই। তাহলে এটি আমাদের সংবিধানে কিভাবে প্রবেশ করলো। নাস্তিকরা সুকৌশলে আমাদের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ এবং সমাজতন্ত্রকে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এটি কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। সারাবিশ্বে সমাজতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতা আর সমাজতন্ত্র বাদ দিয়ে আমাদের কুরআনের দিকেই ফিরে যেতে হবে। তিনি পবিত্র কুরআনের সুরা হজ্বের আয়াত উল্লেখ করে বলেন রাষ্ট্রের মূলনীতি হবে চারটি। এ চারটি নীতি অনুসরন করলেই দেশে আর কোন অশান্তি থাকতে পারে না।
মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেন, যে উদ্দেশ্যে দেশ স্বাধীন হয়েছিল তা আজও সফল হয়নি। মানুষের মৌলিক অধিকার, ভোটাধিকার এবং মত প্রকাশের অধিকারের জন্য দেশ স্বাধীন করা হয়েছিল। কিন্তু আমরা দেখছি আজকে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নাই। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মাধ্যমে আজ মানুষের বাক স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। দেশের যুব সমাজ আজ মাদকাসক্ত। ক্ষমতাসীন দলের লোকরা আজ দিবালোকে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ করছে অথচ এর কোন বিচার নেই। সরকার বিচার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। দলীয় বিবেচনায় আজ মানুষ ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত। জাতীয় ঐক্যের পরিবর্তে বিভেদ তৈরি করা হচ্ছে। আমরা যদি অপশক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারি তাহলে আমাদের বিজয় অনিবার্য।
নূরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও আমাদের ভোটাধিকার নেই। মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। দেশ আজ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে। অনিয়ম আজ নিয়মে পরিনত হয়েছে। দেশপ্রেমিক বিডিআরকে ধবংস করে আজ সীমান্তকে অরক্ষিত করা হয়েছে। জাতীয় নেতৃবৃন্দকে বিনা অপরাধে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে। জাতি হিসেবে আজ আমরা উদ্বিগ্ন। এমতাবস্থায় দেশের উন্নয়ন ও প্রগতি সাধন করে এই দেশকে প্রকৃত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। সংগঠনের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই দেশ গঠনে একটি শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ এবং বসবাসের উপযোগী একটি রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।