বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডাঃ শফিকুর রহমান বলেছেন, পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র জাতি যে ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি। আর এক্ষেত্রে আমাদের সফলতা হলো আমরা প্রাণের বিনিময়ে মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় সমর্থ হয়েছি। আর ব্যর্থতা হচ্ছে বাংলা ৮ ফাল্গুনের পরিবর্তে ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালন করতে হচ্ছে। তিনি ভাষা শহীদসহ সকল ভাষা সৈনিকদের গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন এবং জীবিত ভাষা সৈনিকদের যথাযথ রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদানের সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী উত্তর আয়োজিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভা ও পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তর আমীর মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিনের সভাপতিত্বে এবং কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরীর উত্তরের সেক্রেটারি ডঃ মুহাম্মদ রেজাউল করিমের পরিচালনায় অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি এ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ। আরও বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক গোলাম আযম রাহিমাহুল্লাহ এর জ্যেষ্ঠ পুত্র আব্দুলাহিল মামুন আল-আযমী ও কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও মহানগরীর নায়েবে আমীর জনাব আব্দুর রহমান মুসা প্রমূখ।
আমীরে জামায়াত বলেন, ভাষা আন্দোলনই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি রচনা করেছে। মূলত, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ স্লোগান ও কুরআনকে সংবিধান মেনে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছিল। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইনসাফের কথা বলেছেন। কিন্তু পাক শাসকরা আমাদের প্রতি সুবিচার করতে পারেনি। কিন্তু আমরা দ্বিতীয় দফায় স্বাধীনতা লাভের পরও দেশে গণতন্ত্র নেই; নেই কথা বলার অধিকার। পরিকল্পিতভাবে দেশকে মেধাশূণ্য করা হচ্ছে। ভাষার মাসের বই মেলায় ইসলামী বইয়ের জন্য স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়নি। অথচ মদের ওপেন লাইসেন্স প্রদান করা হচ্ছে। কিন্তু তৌহিদী জনতা সরকারের এই সিদ্ধান্ত কোন ভাবেই মেনে নেবে না।
তিনি বলেন, তমুদ্দন মজলিসের ব্যনারে প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম ভাষা আন্দোলনকে সংগঠিত করেছিলেন। আর ডাকসু সাবেক জিএস অধ্যাপক গোলাম আযম ছিলেন ভাষা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী লিকায়ত আলী খানের কাছে মানপত্রও পাঠ করেছিলেন। রংপুর কারমাইকেল কলেজে অধ্যাপনাকালে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে তাকে বারবার কারাবরণও করতে হয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক সংকীর্ণতার কারণেই ডাকসুর নাম ফলক থেকে তার নাম মুছে ফেলা হয়েছে। তিনি কেয়ারটেকার সরকারের রূপকার ছিলেন। যে চারটি নির্বাচন কেয়ারকেটার সরকারে অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে সেগুলোই অধিকতর গ্রহণযোগ্য হয়েছে। কিন্তু তা তুলে দেয়া হয়েছে। ফলে মানুষ ভোটাধিকার হারিয়েছে। তিনি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে আবারও নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার আহবান জানান।
তিনি আরও বলেন, দেশের উন্নয়নের গল্প শুধু সরকারি তামাশা ছাড়া কিছু নয়। উন্নয়ন বলতে কেবল সরকার দলীয় নেতা এমপি ও মন্ত্রীদের সম্পদ বাড়ছে। কথিত উৎস হিসাবে মাছ চাষের কথা বলা হচ্ছে। আর এসব অর্থ দিয়ে তারা বিদেশে বেগমপাড়া তৈরি করেছে। কিন্তু তাদের মনে রাখা উচিত এদেশ জোয়ার-ভাটার দেশ। আর এদেশে স্বৈরাচারি শক্তি কখনো বেশি দিন টিকে থাকতে পারেনি। তিনি জামায়াতের ওপর সরকারের দলপীড়নের কথা উল্লেখ করে বলেন, সরকার জামায়াতকে নির্মূল করার জন্য সারাদেশে ষাড়াশী অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি বরং অধ্যাপক গোলাম ও মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর হাত ধরে জামায়াতে ইসলামী এখন অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত হয়েছে। তিনি ভাষা আন্দোলনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সমৃদ্ধ দেশ ও জাতি গঠনে সকলকে আত্মনিয়োগ করার আহবান জানান।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ভাষা আল্লাহ তায়ালার দান। ভাষার মাধ্যমে মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করে। আর জন্মের সাথে সাথে ব্যক্তি মায়ের ভাষায় ভাষা রপ্ত করতে শুরু করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, পাক শাসকচক্র আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নেয়ার নির্মম ঘটনা ঘটিয়েছে। তারা উর্দুকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করেছে। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একাধিক রাষ্ট্রভাষা রয়েছে।
সভাপতির বক্তব্যে মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, ভাষা আন্দোলনের প্রথম কাতারের একজন অগ্রসৈনিক ও সংগঠক ছিলেন ডাকসুর সাবেক জিএস অধ্যাপক গোলাম আযম। তিনি পাকিস্তানে ১৯৫৫ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু শ্রেণিবিশেষের রাজনৈতিক সংকীর্ণতার কারণেই মহান ভাষা আন্দোলনসহ জাতীয় ক্ষেত্রে তার অসামান্য অবদানের কথা স্বীকার করা হয় না। কিন্তু শত চেষ্টা করে ভাষা সৈনিক অধ্যাপক গোলাম আযমের নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যায় নি; আর যাবেও না।
তিনি বলেন, মহান ভাষা আন্দোলনের সফলতা আমাদের জাতীয় জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন। আর তার স্বীকৃতি হিসাবেই ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে। তিনি ভাষার জন্য আত্মোৎসর্গকারীদের গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন এবং শহীদদের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনীদের সরকারি ব্যয়ে চিকিৎসা, শিক্ষা এবং প্রয়োজনে বিদেশে উচ্চশিক্ষাসহ প্রয়োজনীয় পুনর্বাসনে সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান। মহানগরী আমীর শহীদ পরিবার ও জীবিত শহীদদের সম্ভব সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাসও প্রদান করেন।