বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা: শফিকুর রহমান বলেছেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মানুষ আশা করেছিল, ন্যায় ইনসাফ কায়েম হবে, মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হবে, মানুষ তার অধিকার ফিরে পাবে। অথচ দেশের মানুষ আজ অনিরাপদ। খুন, গুমের আতংক সমাজকে গ্রাস করে নিয়েছে। দেশের জনগণ সর্বহারা নাগরিক। এভাবে চলতে পারে না। তিনি বলেন, আগামী ২০২৩ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচন বিগত দুটি নির্বাচনের মতো হলে দেশ আরো গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। তাই সকল ভেদাভেদ ভুলে রাজনৈতিক দল-মত নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জনগণের অধিকার জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। জুলুম-নির্যাতন বন্ধের জন্য জনগণের সরকার প্রয়োজন। এজন্য নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের কোন বিকল্প নেই।
আজ শুক্রবার বিকালে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের উদ্যোগে আয়োজিত মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমীর নূরুল ইসলাম বুলবুলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ। কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারি এডভোকেট ড. হেলাল উদ্দিনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সভায় আরও বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের নায়েবে আমীর মঞ্জুরুল ইসলাম ভূঁইয়া, কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের নায়েবে আমীর আব্দুস সবুর ফকির, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, মহানগরীর সহকারী সেক্রেটারি যথাক্রমে মুহা. দেলোয়ার হোসেন, কামাল হোসাইন, অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান প্রমুখ।
ডা: শফিকুর রহমান তাঁর বক্তব্যে বলেন, আজকের এই দিনে গভীর রাতে অন্যায়ভাবে এদেশের নাগরিকদের হত্যা করা হয়। অনিবার্য ফলশ্রুতিতে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ হয়। আশা ছিল দেশটাতে ন্যায় ইনসাফ কায়েম হবে, মুল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হবে, মানুষ তার অধিকার ফিরে পাবে। স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পর এখন বলা হয়, স্বাধীনতা তুমি কার? তিনি বলেন, দেশের মানুষ আজ অনিরাপদ। খুন, গুমের আতংক সমাজকে গ্রাস করে নিয়েছে। তাদের কেউ কেউ বলে দেশটা উন্নত দেশের মতো হয়েছে। সিঙ্গাপুর কানাডার মতো হয়ে গেছে। সে সব দেশের মানুষ কী অনিরাপদ? মানুষের ইজ্জত আব্রু অনিরাপদ?
জামায়াত আমীর বলেন, রমযানের পূর্বে মদের লাইসেন্স অবারিত করে দেয়া হয়েছে। ২১ বছরের বেশী হলে মদ্য পান করতে পারবে বলে আইন করা হচ্ছে। আওয়ামীলীগ বলে তারা কুরআন সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন করবে না। এটাই কী তার নমূনা? তিনি বলেন, যে স্বাধীনতা মানুষের ঈমান নিয়ে যায়, সেই জন্যই কী আমরা দেশ স্বাধীন করেছি? আলেম ওলামাদের জেলে বন্দী করে লাঞ্চিত করা হচ্ছে। এজন্যই কী দেশ স্বাধীন করা হয়েছে?
তিনি বলেন, আমরা একটা পতাকা পেয়েছি। কিন্তু সেই পতাকার সীমানা আজ অরক্ষিত। হাজারো ফেলানীর আর্তনাদ আমরা শুনতে পাই। দু’দিন পরপর আমাদের আশ্বস্ত করা হয়, কিন্তু সীমান্তে গুলি বন্ধ হয় না। ভারত-পাকিস্তান শত্রু রাষ্ট্র বলা হয়। সেখানে কি সীমান্তে এভাবে গুলি হয়? আমরাতো বন্ধু রাষ্ট্র। সীমান্তে লাশ উপহার দেয়া কী বন্ধুত্ব?
ডা: শফিকুর রহমান বলেন, রাষ্ট্রের ৩টি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও আইন বিভাগ। এই ৩টি অঙ্গ আইন অনুযায়ী চলবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই আইন হবে আল্লাহর দেয়া আইন, কুরআন, সুন্নাহর আইন। এটা ছাড়া কোন সমস্যার সমাধান হবে না। এটা আল্লাহরই কথা। ৯০ শতাংশের মুসলমানের এই দেশ এই আইনের ভিত্তিতে চলা উচিত। আমরা সেই আইন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছি। তিনি উল্লেখ করেন, বিচারের নামে আমাদের নেতৃবৃন্দকে হত্যা করা হয়েছে। অফিস বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
আমীরে জামায়াত বলেন, দেশের জনগন সর্বহারা নাগরিক। এভাবে চলতে পারে না। এজন্য জনগনকে সোচ্চার হতে হবে। জনগনের কন্ঠস্বর রাজনৈতিক দলগুলো। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগনের কথা বলতে হবে। তিনি বলেন, জাতীয় ঐক্য এখন বড়ই প্রয়োজন। আসুন আমরা আল্লাহকে ভয় করি, জনগনের কাছে দায়বদ্ধতার কথা স্মরণ করি। ছোটখাটো সকল ভেদাভেদ ভুলে জনগনকে সত্যিকারের মুক্তির স্বাদ পৌছে দিতে হবে। তিনি আরো বলেন, আগামী ২০২৩ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচন বিগত দুটি নির্বাচনের মতো হলে দেশ আরো গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। সকল রাজনৈতিক দল মত নির্বিশেষে সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে, জনগনের অধিকার জনগনের কাছে ফিরিয়ে দেই। তিনি বলেন, জুলুম নির্যাতন বন্ধের জন্য জনগনের সরকার প্রয়োজন। এজন্য নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের কোন বিকল্প নেই। তিনি উল্লেখ করেন, সরকার জনগনের কাছে দেয়া ওয়াদা লংঘন করেছে। দিনের ভোট রাতে করেছে। আবার বড় গলায় বলছে জনগনের ভোটে নির্বাচিত। তারা অর্নগল মিথ্যাচার করছে।
এডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, প্রত্যেকটি গনতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে জামায়াতে ইসলামী অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছে। যারা গণতান্ত্রিক আন্দোলন করেন, তারা অতীত ইতিহাস মুছে ফেলতে চান। কিন্তু এটা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, জুলফিকার আলী ভুট্টো চেয়েছিলেন ক্ষমতায় আসতে। কিন্তু পাকিস্তান এক থাকলে তিনি তা পারতেন না। তাই তিনি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা কোনটাই পাইনি। ভৌগোলিকভাবে স্বাধীনতা পেলেও সত্যিকার অর্থে গনতান্ত্রিক স্বাধীনতা পাইনি। এখন কোন কিছু আলোচনা করা, মত প্রকাশ করারও সুযোগ নেই। তথ্য প্রযুক্তি আইন করে কণ্ঠ রোধ করা হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এখন ভয়াবহ। ৭৪ সালে একজন কবি ইসলামের বিরুদ্ধে কবিতা লিখে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। ইসলামের বিরুদ্ধে লিখে একজন লেখিকাও দেশ ছাড়েন। এখন ৯০% মুসলমানের দেশে মদের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এটা দেশকে কোন পথে নিয়ে যাবে?
সভাপতির বক্তব্যে নূরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, বাংলাদেশে এখন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই। রাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। বর্তমান সরকার আজীবন ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করছে। কঠিন পরিস্থিতিতে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে ভূমিকা পালন করতে হবে। তিনি বলেন, দ্রব্যমূলের উর্ধ্বগতিতে জনগনের নাভিশ্বাস উঠেছে। জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছোয়া। জামায়াতে ইসলামী জনগনকে সাথে নিয়ে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তুলেছে। কিন্তু সরকার অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করে আন্দোলন বন্ধ করতে চায়। তিনি বলেন, সরকার একের পর এক বিরাজনীতিকরনের চেষ্টা করেছে। জামায়াতকে নেতৃত্ব শূন্য করতে শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে হত্যা করে মানবাধিকার লংঘনের চরম ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। কিন্তু নেতৃত্ব শূন্য করার সরকারের চক্রান্ত ব্যর্থ হয়েছে। জনগনের সরকার প্রতিষ্ঠা, ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সকলকে এগিয়ে আসার জন্য তিনি সকলের প্রতি আহবান জানান।
মঞ্জুরুল ইসলাম ভূইয়া বলেন, প্রিয় মাতৃভূমি গড়ার জন্য বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে হবে। অধিকার আদায়ের জন্য ফ্যাসিস্ট ও জালিম এই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
আবদুস সবুর ফকির বলেন, স্বাধীনতার পক্ষ বিপক্ষ তুলে দেশকে বিভক্তির দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এখন উন্নয়নের কথা বলা হয়। অথচ দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে দেশের মানুষ আজ দিশেহারা। পল্টন ময়দানে অনেকে বক্তব্য রাখতেন। তারা আজ কোথায়?
ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পর আজ মানুষ অনিরাপদ। খুন, গুমে মানুষ আতংকিত। মদের লাইসেন্স দিয়ে যুব সমাজের চরিত্র ধ্বংস করার আয়োজন করা হয়েছে। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। পৃথিবীর মানচিত্রে আমরা বাংলাদেশকে একটি সুখি সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে দেখতে চাই।
ড. হেলাল উদ্দিন বলেন, আজকে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাহিরে চলে যাচ্ছে। সেসব ক্ষেত্রে সরকারের কোন মাথা ব্যথা নেই। জনগণের প্রকৃত স্বাধীনতা ভোট চুরি করে এই সরকার ক্ষমতায় টিকে রয়েছে। ক্ষমতাসীনদের কাছে আজ স্বাধীনতা কোন মূল্য বহন করে না। এই অপশক্তির বিরুদ্ধে আমাদেরকে সোচ্চার হতে হবে।
দেলোয়ার হোসেন বলেন, যারা স্বাধীনতার পক্ষে বিপক্ষের বলে দাবী তোলেন তারা প্রকৃত অর্থে জাতিকে বিভক্ত করতে চান। তাদের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন থাকতে হবে। প্রয়োজনে দূর্বার গণআন্দোলন গড়ে তুলে তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।
ড. আব্দুল মান্নান বলেন, মহান আল্লাহ আমাদেরকে স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছেন। মনে রাখতে হবে সেখানে যেন কোন বাড়াবাড়ি না হয়ে যায়। ১৯৭১ সালে আমরা যে স্বাধীনতা পেয়েছি সেই স্বাধীনতা সত্যিকার অর্থে এখনো মুক্তির পথ দেখাতে পারেনি। ৫০টি বছর দেশের অতিক্রান্ত হয়েছে আজও আমরা প্রতিটি মানুষের অন্নের বাসস্থানের ব্যবস্থা সম্পন্ন করতে পারিনি।
কামাল হোসাইন বলেন, বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে রাখার জন্য আমাদেরকে দেশপ্রেমে বলিয়ান হয়ে কাজ করে যেতে হবে। চলমান পরিস্থিতিতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে আরও একটি স্বাধীনতা অর্জনে ভূমিকা রাখতে হবে।