বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী চট্টগ্রাম মহানগরীর উদ্যোগে যাকাত ও ওশর শীর্ষক এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘ইসলামী শরী’য়াহর দৃষ্টিকোণ থেকে যাকাত ও ওশর সম্পর্কিত বিধান ও এর বাস্তবায়ন’। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন কেন্দ্রীয় এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল ও চট্টগ্রাম মহানগরী আমীর মুহাম্মদ শাহজাহান, সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট ইসলামী গবেষক ও আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম’র সাবেক প্রো ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. আবু বকর রফীক আহমদ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান বলেন, “মাহে রমজানের প্রাক্কালে এই ধরনের সেমিনার আয়োজন করায় চট্টগ্রাম মহানগরী জামায়াতকে আন্তরিক মোবারকবাদ জানাচ্ছি। আল্লাহর বান্দাদের জন্য আল্লাহ দুইটি হক নির্ধারণ করে দিয়েছেন, একটি হচ্ছে হাক্কুল্লাহ, আরেকটি হচ্ছে হাক্কুল ইবাদ। যাকাত ও ওশর হচ্ছে হাক্কুল ইবাদের অন্তর্ভুক্ত। অথচ এই বিষয়টির ব্যাপারে মানুষ গাফেল। যাকাত ও ওশরের ব্যাপারে সঠিক জ্ঞান না রাখার কারণে অধিকাংশ মানুষ জাহান্নামের আগুনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। যাকাত শব্দটি তো তাও পরিচিত, কিন্তু ওশর শব্দটি এখনো আমাদের সমাজে পরিচিত নয়। শুধু ওশর আদায় করলে তা বছরে হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। যাকাত ওশরের ব্যাপারে মানুষকে জাগানোর জন্যই আজকের এই আয়োজন। এই জাগানোর দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে।
যাকাত আদায়ের বিষয়ে আমীরে জামায়াত বলেন, যেনতেন রাষ্ট্র যাকাত আদায়ের অধিকার রাখে না। আল্লাহর হারাম জিনিসকে যারা হালাল করে দেয়,আল্লাহ যেটাকে সুস্পষ্টভাবে হারাম ঘোষণা করে দিয়েছেন, সেই মদকে যারা বৈধতা দেয়,তাদের কোনো অধিকার নেই যাকাত আদায়ের। এ ধরনের রাষ্ট্র যাকাত আদায় করার সুযোগ পেলে দ্বীনদার জনগণের অর্থ লুন্ঠন করবে। কেবলমাত্র রাষ্ট্রে যারা আমর বিল মা’রুফ ওয়া নাহি আ’নিল মুনকার এর দায়িত্ব পালন করবে, আল্লাহকে ভয় করবে, শুধু তাদের অধিকার রয়েছে। সহজ কথায় যে সরকার কুরআন সুন্নাহর আইন মানে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে যাকাত আদায়ের কী হবে। পবিত্র কুরআনে তো শুধু যাকাত দিতে বলা হয়নি, যাকাত আদায়ের কথা বলা হয়েছে। এর উত্তর হচ্ছে,আমানতদার উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে যার হক্ব তার কাছে সম্মানের সাথে পৌঁছে দিয়ে সমাজকে দারিদ্রের যাতনা থেকে মুক্ত করবে।
তিনি আরো বলেন, দারিদ্রতা বিমোচনে যাকাত ব্যবস্থার বিকল্প নেই। এছাড়াও আরো একটি বিষয় আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, যাকাত দেয়ার সময় রিয়ার প্রবল আশঙ্কা আছে। আর রিয়া শিরকের অন্তর্ভুক্ত। তাই রিয়ার এই গর্হিত কাজ থেকে বাঁচতে যাকাতদাতাকে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, যাকাতের উদ্দেশ্য হচ্ছে দারিদ্র দূরীকরণ ও সম্পদের বিকেন্দ্রীকরণ। শাড়ি লুঙ্গি দিয়ে দারিদ্র বিমোচন সম্ভব নয়, দরিদ্র মানুষের হাতে কিছু করার মতো বিনিয়োগ বা পুঁজি তুলে দিতে হবে,যাতে সে দ্বিতীয়বার আর হাত না পেতে আত্বমর্যাদাবোধ নিয়ে জীবনযাপন করতে পারে।
আজকের এই সেমিনার থেকে যে জ্ঞান অর্জন করেছেন, সেই আলোকে সবাইকে বলতে চাই, আপনারা পুরোপুরিভাবে কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন যাপন করার চেষ্টা করুন। আপনারা জামায়াতের কাজে সহযোগিতা করুন। নিজ পরিবার, সন্তান, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের জামায়াতের সাথে শামিল করুন। আজকের এই সেমিনার সফল হোক সেই প্রত্যাশা করি।”
প্রবন্ধ উপস্থাপক প্রফেসর ড. আবু বকর রফীক বলেন, ”যাকাত হচ্ছে ইসলামী শরী‘আহর অন্যতম মৌলিক বিধান। পবিত্র আল কুরআনের অন্তত: পঁচিশটি আয়াতে সালাত প্রতিষ্ঠার সাথে একত্রিত ভাবে যাকাত প্রদানের বিষয়টি উল্লেখিত হয়েছে। গুরুত্বের বিচারে সালাতের পরেই এর স্থান। যাকাতের গুরুত্ব ইসলামী শরী‘আতে কত বেশী তা বুঝার জন্য একটি ঘটনার উল্লেখই যথেষ্ট। ইসলামের প্রথম খলীফা আবু বকর রা. শাসনকালের সূচনা লগ্নে কিছু সংখ্যক গোত্র যখন দাবী জানাল যে, আমরা নামায রোজা ইত্যাদি বিধানগুলো মেনে চলবো, কিন্তু যাকাত প্রদান থেকে অব্যাহতি চাই। তখন আবু বকর ছিদ্দীক তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিলেন।
যাকাতের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে যাকাত দাতার মন মানসিকতা পরিশুদ্ধ করা, তার সম্পদ পবিত্র করা এবং সমাজকে দারিদ্রের অভিশাপ থেকে মুক্ত করা। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে যাকাত হচ্ছে অন্যতম রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, তাই যতদিন ইসলাম রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি ততদিন সরাসরি যাকাতের বিধান অবতীর্ণ হয়নি।
যাকাতের মত ওশরও একটি ইসলামী পরিভাষা। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে এক দশমাংশ। যেহেতু জমিতে উৎপাদিত ফসলের উপর মূলত: এক দশমাংশ হারে যাকাত প্রদেয় তাই এর নামকরণ করা হয়েছে ওশর। তবে ক্ষেত্র বিশেষে এর পরিমাণ পাঁচ শতাংশও হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে বলা হয় নিছফ ওশর। ওশর বা নিছফ ওশর জমির ফসলের উপরই আরোপিত একটি বাধ্যতামূলক ছাদাক্বা।”
সভাপতির বক্তব্যে নগর আমীর মুহাম্মদ শাহজাহান বলেন, পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা বিশ্ব অর্থনীতির ভারসাম্যকে চুরমার করে দিয়েছে। দারিদ্র ও বেকারত্ব পৃথিবীর অন্যতম প্রধান সমস্যা। সমাজ থেকে দারিদ্রতা বিমোচন ও বেকারত্ব দূর করে জামায়াত সকল নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করতে চায়। যাকাত সম্পদের পবিত্রতা সাধনের পাশাপাশি সম্পদের প্রবৃদ্ধিও ঘটায়।
তিনি বলেন, শাড়ি লুঙ্গি বিতরণের মাধ্যমে যাকাত প্রদান ফ্যাশনে পরিণত হয়ে গেছে। অথচ শাড়ি লুঙ্গি প্রদানের মাধ্যমে যাকাতের মূল উদ্দেশ্য তথা দারিদ্রতা বিমোচন কোনভাবে সম্ভব নয়। তিনি আরো বলেন, ন্যায় ও ইনসাফ ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে কেউ তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেনা। তাই প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে জামায়াতে ইসলামী মানবতার কল্যাণে নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
যাকাত ও ওশর বিষয়ক এই সেমিনারের মাধ্যমে আমরা রাষ্ট্র ও জনগণ কে সচেতন করতে চাই এবং যাকাত ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় সক্রিয় ভূমিকা রাখতে সবাইকে উদাত্ত আহ্বান জানাই।
নগর সেক্রেটারি অধ্যক্ষ মুহাম্মদ নুরুল আমীন এর সঞ্চালনায় সেমিনারে উপস্থাপিত প্রবন্ধের উপর আরো বক্তব্য রাখেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়ার সাবেক ডিন প্রফেসর ড. আবুল কালাম পাটোয়ারী, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টারের পরিচালক ড. সামিউল হক ফারুকী, ওয়ার্ল্ড মুসলিম হেরিটেজ রিসার্চ সেন্টারের গ্লোবাল প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ড. মুহাম্মদ রুহুল আমীন, নগর জামায়াতের নায়েবে আমীর আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ ও মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. বশির কাসেমী প্রমুখ।