বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের প্রধান উপদেষ্টা ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, দেশের শ্রমজীবী মানুষরা সমাজ-রাষ্ট্রে চরম অবহেলিত। অথচ তাদের শ্রম ও ঘামে রাষ্ট্র সচল থাকে। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য শ্রমজীবী মানুষদের গুরুত্ব দিতে হবে। শ্রমজীবী মানুষের প্রাপ্য অধিকার, ভালোবাসা ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের প্রতি সকলকে মানবিক হতে হবে।
তিনি আজ বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন কর্তৃক ভাচুয়ালি আয়োজিত জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিনিধি সম্মেলন’২২ এ প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক হারুনুর রশিদ খান-এর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আতিকুর রহমান-এর সঞ্চালনায় এতে সম্মেলনে আরও বক্তব্য রাখেন ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি গোলাম রব্বানী, লস্কর মোঃ তসলিম, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের খান, মাস্টার শফিকুল আলম, কবির আহমদ, মজিবুর রহমান ভূইয়া, মনসুর রহমান, সহসাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আলমগীর হোসাইন, দপ্তর সম্পাদক নুরুল আমিন প্রমুখ।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন দেশের ঐহিত্যবাহী শ্রমিক সংগঠন। এই সংগঠন প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে মালিক ও শ্রমিকের মাঝে ভ্রাতৃত্বের সেতু বন্ধন তৈরি করতে কাজ করে যাচ্ছে। এই সংগঠন বিশ্বাস করে মালিক ও শ্রমিকের মাঝে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলে শ্রমিক-মালিক কারোই লাভ হবে না। বরং এতে আরও শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এক শ্রেণির নেতারা মালিক ও শ্রমিকের মাঝে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে নিজেরা লাভবান হওয়ার পথ খুঁজে। তারা সংকটের দোহাই দিয়ে মালিকের প্রতি চাপ সৃষ্টি করে। অতঃপর মালিকের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা আদায় করে।
তিনি আরও বলেন, এই শ্রেণির নেতাদের হাত থেকে সাধারণ মেহনতি শ্রমিকদের রক্ষা করতে হবে। এই জন্য সর্বপ্রথম এখলাসের সাথে শ্রম অঙ্গনে কাজ করতে হবে। শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানের জন্য শ্রম আইন অনুসারে ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে নির্যাতিত নিপীড়িত শ্রমিকের পাশে দাঁড়াতে হবে। মজলুম শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য মালিকদের সাথে আলাপ-আলোচনা করতে হবে। মালিককে বুঝাতে হবে শ্রমিকরা আপনরাই ভাই। তাদের পূর্ণ সুযোগ-সুবিধা দিলে আপনি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। বরং মালিকের কাছ থেকে শ্রমিকরা তাদের প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার পেলে শ্রমিকরাই মালিকের উন্নতির জন্য আরও বেশি নিজেদের নিয়োজিত করবে।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, শ্রমিক ময়দান শক্তিশালী না হলে আদর্শিকভাবে আমরা এগিয়ে যেতে পারবো না। তাই দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আমাদেরকে আরও বেশিভাবে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। সকল পেশার শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নে সংগঠিত করতে হবে। শ্রমিকদের মাধ্যমে আগামী দিনে এই রাষ্ট্রের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সাধন করতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক হারুনুর রশিদ খান গতকাল মধ্যরাতে শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের পাবনা জেলা সভাপতি অধ্যাপক রেজাউল করিমকে গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। একই সাথে তিনি ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি আ ন ম শামসুল ইসলামসহ সকল শ্রমিক নেতাদের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেন।
তিনি আরও বলেন, সাধারণ শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের জন্য ট্রেড ইউনিয়নের বিকল্প কিছু নেই। প্রতিটি পেশার শ্রমিকদের নিয়ে স্ব স্ব পেশায় ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শ্রম আইন পুরোপুরি শ্রমিকবান্ধব না হলেও সেখানে শ্রমিকদের জন্য বেশ কিছু সুযোগ ও অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এসব অধিকার সম্পর্কে জানতে হলে শ্রম আইন জানতে হবে। শ্রম আইন জানা ট্রেড নেতৃবৃন্দের জন্য অপরিহার্য। ট্রেড ইউনিয়নের কাজ ও সেবার মাধ্যমে শ্রমিকদের মন জয় করতে হবে। এক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দকে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে।
সম্মেলনে নিম্মোক্ত প্রস্তাবনা গৃহীত হয়েছে
১.বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ২৩, ২৬ ও ২৭ ধারাসমূহ বাতিল করে আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ এর আলোকে শ্রম আইন প্রণয়ন এবং শ্রম আইনকে প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক সকল শ্রমিকের অধিকার, নিরাপত্তা ও ন্যায্যতা উপযোগী করে তৈরি করতে এই সম্মেলন জোর দাবি জানাচ্ছে।
২.এই সম্মেলন দাবি করছে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের ক্ষেত্রে সকল বাধা দূর করা, ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের হয়রানি বন্ধ এবং শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাবেক এমপি আ ন ম শামসুল ইসলাম, ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, ফেডারেশনের পাবনা জেলা সভাপতি অধ্যাপক রেজাউল করিম, নওগাঁ জেলা পশ্চিমের সভাপতি শামসুল হুদা, কৃষিজীবী শ্রমিক নেতা খায়রুল হকসহ সকল নেতৃবৃন্দের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে।
৩.এই সম্মেলন শিল্প-কলকারখানায় ‘কালাকানুন’ টার্মিনেশন এ্যাক্ট বাতিল করে পূর্বের আইন বহাল করা, শ্রমিক ছাটাই বন্ধ, শিল্প-কলকারখানার মুনাফায় শ্রমিকদের অংশ প্রদান, শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন ফান্ডের যথাযথ ব্যবহার, রেশনিং ব্যবস্থা চালু এবং শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছে।
৪.আজকের এই সম্মেলন চাল-ডাল ও তৈলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং দ্রব্যসামগ্রী শ্রমজীবী মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসার জন্য সরকারের নিকট জোর দাবি জানাচ্ছে।
৫.এই সম্মেলন মনে করে, সম্প্রতি জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তাই জ্বালানি তেলের দাম কমাতে এই সম্মেলন সরকারের প্রতি জোড় দাবি জানাচ্ছে।
৬.এই সম্মেলন বন্ধকৃত ২৫টি জুট মিলসহ সকল বন্ধকৃত কলকারখানার শ্রমিক কর্মচারীদের যাবতীয় বকেয়া পাওনাদি পরিশোধ এবং সকল বন্ধকৃত মিল, কলকারখানা খুলে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে।
৭.আজকের এই ঐতিহাসিক সম্মেলন শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ের নিরীখে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি কাঠামো পুনঃনির্ধারণ ও বাস্তবায়নের জোর দাবি জানাচ্ছি এবং সর্বস্তরের শ্রমিকদের জন্য ট্রেডভিত্তিক সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করা ও তা সমাধান এবং অপ্রতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিসহ সকল ক্ষেত্রে শ্রম আইনের সঠিক প্রয়োগ ও ইনসাফভিত্তিক শ্রমনীতি প্রণয়নের আহ্বান জানাচ্ছে।
৮.আজকের এই সম্মেলন মনে করে যে, শ্রমজীবী মানুষের প্রকৃত সমস্যার সমাধান ইসলামী শ্রমনীতি বাস্তবায়ন ছাড়া সম্ভব নয়। তাই ইসলামী শ্রমনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শ্রমজীবী মানুষসহ সকল স্তরের শ্রমিক জনতাকে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের পতাকাতলে শামিল হওয়ার জোর আহ্বান জানাচ্ছে।