বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডাঃ শফিকুর রহমান বলেছেন, আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা সরাসরি রাসুল (ﷺ)-কে জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন। রাসুল (ﷺ) ছিলেন একই সাথে শিক্ষক ও বাস্তবায়নকারী। তিনি জ্ঞান ও প্রজ্ঞার শিক্ষক, মানুষকে তালিম দিয়েছেন। রাসুল (ﷺ) বলেছেন, আমাকে পাঠানো হয়েছে শিক্ষক হিসেবে। মহান আল্লাহ তাঁর রাসুলকে নিয়ে চমৎকার দু’টি কথা বলেছেন, এক: আপনাকে (রাসুলকে) আমি আখলাকের সর্বোত্তম নেয়ামত দিয়ে পাঠিয়েছি। দুই: রাসুলের মাঝেই রয়েছে মানব জীবনের সর্বোত্তম আদর্শ। অর্থাৎ রাসুলের মাঝেই রয়েছে সকল কিছুর সমাধান। কাজেই বিশ্ব শান্তির জন্য রাসুল (ﷺ)-এর সার্বজনীন আদর্শের বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর চরিত্রকে এমনভাবে হেফাযত করেছেন, নবুওয়াতের আগে পরে বিন্দুমাত্র পার্থক্য নেই, যার জীবনে এতোটুকু দাগ নেই। জ্ঞানপাপীরা মাঝে মধ্যে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে মিথ্যা ছড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সেই যুগে রাসুল (ﷺ)-এর শত্রুরা পর্যন্ত সাক্ষ্য দিয়েছেন তাঁর চরিত্রের ব্যাপারে। যেকোন ধর্মের অনুসারীই হোক না কেন, বিশ্বনবী সম্পর্কে গবেষণা করলেই তাঁর জীবনের পাতায় পাতায় শুধু অনুকরণীয় আদর্শ খুঁজে পাবে। নবুওয়াত পূর্ব যুগ কত জাহেলী ছিল, মদ-নারী-শিশু হত্যা-বেহায়াপনা ছিল সেই যুগের মানুষদের নিত্যকর্ম, অথচ সে জাহেলী যুগে বসবাস করেও রাসুল (ﷺ)-এর গায়ে এতোটুকু কালিমা লাগেনি, যেহেতু আল্লাহ তা’য়ালা তাঁকে নবী বানাবেন, তাই ছোট বেলা থেকে মহান আল্লাহ নিজেই তাঁকে হেফাজত করেছেন। রাসুল (ﷺ) ছিলেন সর্বোত্তম আমানতদার, যিনি হিজরতের সময় শত্রুদের আমানত পর্যন্ত ফেরত দিয়ে গেছেন আলী (রা.)-এর মাধ্যমে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী চট্টগ্রাম মহানগরী আয়োজিত মাহে রবিউল আউয়াল উপলক্ষে সিরাতুন্নবী (ﷺ)-এর আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে আমীরে জামায়াত এসব কথা বলেন। কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও চট্টগ্রাম মহানগরীর আমীর মুহাম্মদ শাহজাহানের সভাপতিত্বে ও কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য ও চট্টগ্রাম মহানগরীর সেক্রেটারি অধ্যক্ষ মুহাম্মদ নুরুল আমীনের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল মাদ্রাসার সাবেক অধ্যক্ষ ড. মাওলানা সাইয়েদ আবু নোমান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের সাবেক খতিব মাওলানা এবিএম ছিদ্দিক উল্লাহ, নগর জামায়াতের নায়েবে আমীর মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম, সহকারী সেক্রেটারি মাওলানা খায়রুল বাশার, মুহাম্মদ উল্লাহ, সাংগঠনিক সম্পাদক মোরশেদুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক কাউন্সিলর অধ্যক্ষ শামসুজ্জামান হেলালী। এতে দেশবরেণ্য উলামা-মাশায়েখ ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, লন্ডন, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও কাতারসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সহস্রাধিক শ্রোতা আলোচনা শুনতে ফেসবুক ও জুমে অংশগ্রহণ করেন।
ডা. শফিকুর রহমান আরো বলেন, সংস্কৃতির সংকট মোকাবেলায় রাসুল (ﷺ- এর আদর্শ সর্বোত্তম। রাসুলের পুরো জীবনটা এতো চমৎকার, এতো বৈচিত্র্যময়, এতো কল্যাণের, মানুষ বছরের পর বছর গবেষণা করলেও তার জীবনী লিখে শেষ করা যাবে না। মানুষের রক্ত যখন মানুষের জন্য হালাল ছিল, কোনো মেয়ে জন্ম নিলে তাকে হত্যা করা সংস্কৃতি ছিল, মানুষকে দাস বানানো হতো হরহামেশা, এরকম একটি জাহেলি সমাজকে রাসুল পরিবর্তন করলেন একজন শিক্ষক হিসেবে। যারা জাহেলী যুগে অপরাধ করতো, তাদের জীবন রাসুলের স্পর্শে পুরোদস্তর পাল্টে গেল। পুরো সমাজ হয়ে গেল পরিবর্তন। সভ্যতার জন্য এই পরিবর্তন অনিবার্য ছিল।
তিনি বর্তমান পরিস্থিতিকে সামনে রেখে বলেন, আজকে বিশ্বের অবস্থা কী ভালো? দেশের অবস্থা কী ভালো? জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই, ন্যুনতম মানবাধিকার নেই। সর্বত্র অশান্তি বিরাজ করছে, পুরো পৃথিবীকে শান্তির চাদরে ঢেকে দিতে হলে শুধুমাত্র রাসুল (ﷺ) এর আদর্শের কাছেই আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে। আর এই ব্যাপারটা আমরা যত তাড়াতাড়ি বুঝব তত দ্রুত আমাদের জন্য কল্যাণ হবে। কেউ আমাদের শত্রু নয়, আমরা সকলের শুভাকাঙ্ক্ষী, আমরা সবার দুটো কল্যাণ চাই, এক, দুনিয়ার শান্তি, দুই, আখিরাতে মুক্তি। সবার প্রতি আমাদের দায় ও দরদ রয়েছে। তাই এই দায়বদ্ধতা থেকে আমরা ইকামাতে দ্বীনের কাজ করে যাব ইনশাআল্লাহ। তিনি বলেন চট্টগ্রামকে বলা হয় ইসলামের প্রবেশদ্বার। বাংলাদেশের জন্য একটি আইকনিক এরিয়া। আল্লাহর যোগ্য নেক বান্দারা এখানে রয়েছেন। ইনশাআল্লাহ বাংলাদেশে ইসলামী সমাজ বিনির্মাণে চট্টগ্রাম সবার আগে এগিয়ে আসবে। তিনি বলেন মক্কার মুশরিকরা রাসুল (ﷺ)-কে প্রস্তাব দিয়েছিল, আসুন কিছুদিন আমরা আপনার প্রভুর ইবাদাত করব, আর কিছুদিন আপনি আমাদের প্রভুর ইবাদাত করবেন। তখন দৃঢ়কণ্ঠে রাসুল (ﷺ) বলেছেন, আমার ডান হাতে যদি চাঁদ আর বাম হাতে সূর্য এনে দিলেও আমি কেবল আল্লাহর ইবাদাতের কথায় বলব। এই যে আদর্শের প্রতি অবিচল ও দৃঢ়তা রাসুল আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, সেই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে আমরাও দৃঢ়তার সাথে কাজ করে যাব ইনশাআল্লাহ।
পরিশেষে আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান বলেন, কথার ফুলঝুরি দিয়ে নয়, রাসুল (ﷺ)-এর আদর্শ থেকে শিক্ষা নিয়ে তাকওয়া ও আখলাক গঠনের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে হবে। আমাদেরকে আমাদের প্রিয় নবীর শ্রেষ্ঠ উম্মাত হতে হবে। সব ধরণের লোভ লালশা, ভয় ভীতিকে পায়ে ঠেলে দিয়ে আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে। যদি আমরা এভাবে চলতে পারি তাহলে আসমান জমিন সমান জান্নাত আমাদেরকে দেয়া হবে। আল্লাহ আমাদের সত্যিকার মুত্তাকী হওয়ার তাওফীক দিন। তিনি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশ্বনবীকে (ﷺ) আদর্শ নেতা হিসাবে অনুসরণ করতে সকলের প্রতি আহ্বান জানান।
সভাপতির বক্তব্যে কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও নগর আমীর মুহাম্মদ শাহজাহান বলেন, মাসব্যাপী সিরাত বিষয়ক কর্মসূচীর অংশ হিসেবে আজকের আলোচনা সভায় উপস্থিত আলোচক ও শ্রোতা সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও আন্তরিক অভিবাদন জানাচ্ছি। বিশ্ব পরিস্থিতি ক্রম অবনতিশীল, ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ, আজকের পৃথিবী বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার হলেও মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত, এর পেছনে যদি আমরা কারণ খুঁজতে যাই কেন আজ বিশ্বে এতো অশান্তি, কেন মারণাস্ত্রের দামামা বাজছে! তার একটাই কারণ আজকের পৃথিবী বিশ্ব নবীর আদর্শে শাসিত হচ্ছে না। আজকে যারা বিশ্ব শাসকের আসনে বসে আছে, দুনিয়াকে শাসন করার জন্য যে নীতি মতবাদ গ্রহণ করেছে, সেই মতবাদ দিয়ে কখনো নিপীড়িত মানুষকে শান্তি দেয়া যাবে না, পৃথিবীকে শান্ত করা যাবে না। আমাদের প্রিয় নবী নির্দিষ্ট কোন ভূখন্ডের নেতা নন, নির্দিষ্ট কোন জাতির নেতা নন, তাকে এই পৃথিবীর সাদা-কালো, আরব-আযম সকল মানুষের নবী করে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরণ করা হয়েছে এবং নবুওয়াতের ধারাও আমাদের রাসুলের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়েছে। আমাদের রাসুলের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে পরিপূর্ণ ঘোষনা করেছেন। আজকে আমরা এই আদর্শকে বাদ দিয়ে, বিশ্ব নবীর নেতৃত্বের মডেল বাদ দিয়ে যাই করি না কেন আমরা সাম্য ও ইনসাফের পৃথিবী গঠন করতে পারব না। ইনশাআল্লাহ সকল মতবাদ ব্যর্থ হওয়ার পর অবশেষে ইসলাম আবার বিজয়ী শক্তি হিসেবে পৃথিবীতে ফিরে আসার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের দুটো জিনিস মনে রাখতে হবে, রাসুল সাঃ হচ্ছেন জীবন্ত কুরআন এবং রাসুল সা. এর বিপ্লব কোন শক্তিমত্তা বা তলোয়ারের বিপ্লব ছিল না, এটা ছিল চারিত্রিক বা আখলাকের বিপ্লব। তাই নতুন সভ্যতার জন্ম দেয়ার পথ একটি, আল জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ। এই কঠিন দায়িত্ব পালনের জন্য আম্বীয়া-কেরামদের মতো আমাদেরকেও সংগ্রামী ও ঝুঁকিপূর্ণ জীবন গ্রহণ করতে হবে। আমরা এই সমাজকে পরিবর্তন করতে চাই, চাই নতুন এক মানবিকতার পৃথিবী। এ দায়িত্ব পালনে সফল হতে হলে উন্নত আখলাক আর তাক্বওয়ার ভিত্তির উপর নিজেদের জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। কেননা মানব জীবনের প্রকৃত সাফল্য ও মর্যাদার মাপকাঠি হলো তাক্বওয়া। জাহেলিয়াতকে পরাভূত করার মতো যোগ্যতা আমাদের অর্জন করতে হবে। রাসুল সা. যেহেতু জীবন্ত কুরআন ছিলেন, আমাদেরকে তার আলোকে জীবন গঠন করতে হবে, জীবনকে রাঙাতে হবে আল্লাহর রঙে। আজকের এই আলোচনা সভা থেকে এই হোক আমাদের শিক্ষা।
বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও শিক্ষাবিদ এবং চট্টগ্রাম বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল মাদ্রাসার সাবেক অধ্যক্ষ ড. মাওলানা সাইয়েদ আবু নোমান বলেন, আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় রাসুল সা.-এর শিক্ষার ভার নিজেই গ্রহণ করেছেন। রাসুল সা. শিক্ষকসুলভ আচরণের মাধ্যমে আরবদের মাঝে লুক্কায়িত সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার কর্মসূচিতে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছিলেন। শুধু তাই নয় তিনি মানবকুলের শ্রেষ্ঠ স¤পদ হিসেবে জ্ঞানকেই আখ্যায়িত করলেন।
বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জামে মসজিদের সাবেক খতীব ও প্রবীণ আলেম মাওলানা আবু বকর মুহাম্মদ ছিদ্দিক উল্লাহ বলেন, ইসলামে ন্যায়বিচারের শিক্ষা এমন এক অনিন্দ্য সুন্দর শিক্ষা, যা ন্যায়পরায়ণ প্রত্যেক অমুসলিমও শুনে প্রশংসা না করে পারে না। পৃথিবীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করাই মহানবী সা.-এর আগমনের উদ্দেশ্য এবং তিনি নিজ আমল দ্বারা সর্বত্র ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষমও হয়েছিলেন। আল্লাহতায়ালার অনুপম শিক্ষা এবং ইসলামের সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির বহিঃপ্রকাশ তখনই সম্ভব হবে, যখন প্রত্যেক মুসলমান আল্লাহপাকের প্রতিটি আদেশের ওপর আমল করবে।
কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সদস্য ও চট্টগ্রাম মহানগরীর নায়েবে আমীর এবং বিশিষ্ট পরিবেশবিদ মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, জীবনধারণের উপায়-উপকরণগুলো সর্বশক্তিমান আল্লাহর দেয়া নিয়ামত। আমরা যে পানি পান করি আর যে বাতাসে শ্বাস নিই তা এর দৃষ্টান্ত। কারণ পানির স্বাদ তো তিক্তও হতে পারতো। আর বাতাস হতে পারতো বিষাক্ত ধোঁয়া যাতে শ্বাস নেয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়াতো। এ সব প্রাকৃতিক সম্পদসমেত সবকিছু অবশ্যই পরিমিতভাবে ব্যবহার করতে হবে।
এছাড়াও উক্ত আলোচনা সভায় সিরাত বাস্তবায়ন কমিটির আহ্ববায়ক ও নগর জামায়াতের নায়েবে আমীর ড. আ জ ম ওবায়েদুল্লাহসহ মহানগরী ও থানা নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।