বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, নির্বাচনের আগে সরকারকে অবশ্যই দুটি কাজ নিশ্চিত করতে হবে। একটি হচ্ছে খুনিদের বিচার, আর এ বিচার অবশ্যই দৃশ্যমান হতে হবে। আরেকটি হচ্ছে প্রয়োজনীয় সংস্কার। এ দুটি ছাড়া বাংলাদেশের জনগণ কোনো নির্বাচন মেনে নিবে না।
১৯ এপ্রিল সকালে কালেক্টরেট মাঠে লালমনিরহাট জেলা জামায়াত আয়োজিত জেলা আমীর আবু তাহেরের সভাপতিত্বে এবং সেক্রেটারি এড. ফিরোজ হায়দার লাভলুর সঞ্চালনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে আমীরে জামায়াত এসব কথা বলেন।
বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা মমতাজ উদ্দিন ও অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বেলাল, রংপুর মহানগর আমীর এটিএম আজম খান, রংপুর জেলা আমীর অধ্যাপক গোলাম রব্বানী, কুড়িগ্রাম জেলা আমীর আবদুল মতিন ফারুকী, লালমনিরহাট-২ (আদিতমারী-কালীগঞ্জ) আসনে জামায়াত মনোনীত প্রার্থী এড. ফিরোজ হায়দার লাভলু, লালমনিরহাট-১ (হাতীবান্ধা-পাটগ্রাম) আসনে জামায়াত মনোনীত প্রার্থী জনাব আনোয়ারুল ইসলাম রাজু, লালমনিরহাট-৩ (সদর) আসনে জামায়াত মনোনীত প্রার্থী জনাব হারুনুর রশিদ এবং শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন সাবেক জেলা আমীর এড. আবদুল বাতেন, সাবেক জেলা আমীর সহ-অধ্যাপক আতাউর রহমান, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলা সভাপতি হাফেজ আজহারুল ইসলাম, গণঅধিকার পরিষদের লালমনিরহাট জেলার আহবায়ক নূরনবী সরকার, হেফাযত আন্দোলনের লালমনিরহাট জেলার আহবায়ক মাওলানা জয়নুল আবেদীন, খেলাফত মজলিসের লালমনিরহাট জেলা সভাপতি মুফতি আবুল কাশেম, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যসচিব মুহাম্মাদ হামিদুর রহমান, লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার হিন্দু কল্যাণ ট্রাস্টের সভাপতি পুষ্পাজিদ বর্মা প্রমুখ।
তিনি আরও বলেন, যারা ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করে রাখার জন্য একেবারে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল, মানুষের জীবন যাদের কাছে কোনো জীবনই ছিল না, তারা ক্ষমতার একেবারে শেষপ্রান্তে এসে সরাসরি স্পষ্ট দিবালোকে মানুষের বুকে গুলি ছুড়ে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। সাড়ে ১৫ বছর তারা এভাবে মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে জেলে বন্দি করে রেখেছে, অসংখ্য মানুষকে তারা গুম করে আয়নাঘরে বন্দি করে রেখেছে এবং খুন করেছে। শুধু গত অভ্যুত্থানেই তারা দেড় হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করেছে এবং ২৪ হাজারের বেশি মানুষকে জীবনের তরে পঙ্গু করে দিয়েছে। অনেকেই প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় কাতরাচ্ছে।
এমতাবস্থায় নির্বাচনের আগে সরকারকে অবশ্যই দুটি কাজ নিশ্চিত করতে হবে। একটি হচ্ছে খুনিদের বিচার, আর এ বিচার অবশ্যই দৃশ্যমান হতে হবে। আরেকটি হচ্ছে প্রয়োজনীয় সংস্কার। এ দুটি ছাড়া বাংলাদেশের জনগণ কোনো নির্বাচন মেনে নিবে না। প্রধান উপদেষ্টা বারবার ঘোষণা দিয়েছেন এবারের ডিসেম্বর থেকে আগামী জুনের মধ্যে ইলেকশন হবে। আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বিনয়ের সাথে বলব- আমরা ইলেকশন চাই, সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। আমরা চুরি-ডাকাতি আর কালো টাকার প্রভাবযুক্ত নির্বাচন দেখতে চাই না। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অবশ্যই সমতল মাঠ তৈরি করতে হবে। আমরা সরকারকে এই দায়িত্ব পালনে সকল ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছি। আমরা এও বিশ্বাস করি সংস্কার এবং খুনিদের বিচার নিশ্চিত করতে পারলেই সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ তৈরি হবে।
তিনি লালমনিরহাটবাসীকে এই জনসভায় যোগ দিয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করায় তাদেরকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আমাদের সকল আহ্বান ও বক্তব্য আপনারা ঘরে ঘরে গিয়ে পৌঁছে দিন। মা বোনদের বলবেন, আগামীর বাংলাদেশ যখন কুরআনের ভিত্তিতে গড়ে তোলা হবে, তখন নারীদের মায়ের মর্যাদা দিয়ে সম্মানিত করা হবে। বোনদের বলবেন, তাদের জন্য এই সমাজ সম্মান ও মর্যাদার হবে। মেয়েদের বলবেন, তাদেরকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা হবে। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বলবেন, ধর্মের ভিত্তিতে বাংলাদেশকে বিভক্ত হতে দেওয়া হবে না। আমরা সকলে কাঁধে কাঁধ মিলে শান্তি ও সম্মানের সাথে সকল সুযোগ-সুবিধা সমানভাবে ভাগ করে নিব। কাউকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে না। বিপদে এবং সুখে আমরা পরস্পরের সঙ্গি হবো, পাশে থাকব। আমরা পরস্পরের ভালবাসা নিয়ে মিলেমিশে থাকতে চাই। এভাবেই আমরা বৈষম্যমুক্ত, দুঃশাসনমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত আগামীর মানবিক বাংলাদেশ গড়তে চাই। জাতি গঠনমূলক এই লড়াই-সংগ্রামে আমরা সারাদেশের মত লালমনিরহাটবাসীকে সাথে চাই, বুকে চাই, আপনাদের অন্তরে একটু ঠাঁই চাই।
তিনি আরও বলেন, গত সাড়ে ১৫ বছর যাবৎ আমরা কথা বলতে পারিনি। জনগণের বাঁচার অধিকার ছিল না। মানুষের কর্মসংস্থানের অধিকার এবং ইজ্জত-আব্রু কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশকে একটি জীবন্ত কারাগারে পরিণত করা হয়েছিল। তারা গুম করে, খুন করে, হামলা করে, জুলুম-নির্যাতন করে, আয়নাঘর বানিয়ে বাংলাদেশের মানুষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস বলে এভাবে মানুষকে দাবিয়ে রাখা যায় না। তারা বাংলাদেশের বিপ্লবী জনগণকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। সাড়ে ১৫ বছরের আন্দোলন, ত্যাগ এবং কুরবানী এবং আমাদের সন্তানদের নেতৃত্বে তারা শুধু গতি ছাড়তেই বাধ্য হয়নি, তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। যারা দেশপ্রেমিক, যারা দেশকে ভালবাসে, তারা কখনই দেশ ছেড়ে পালায় না, বিদেশে বেগম পাড়া বানায় না। দেশের কষ্টার্জিত টাকা বিদেশে পাচার করে না। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় কেনা অস্ত্র দিয়ে জনগণের বুকে তাক করে না। তারা চেয়েছিল ফিরাউনের মত এ দেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে। বিপরীতে তাদেরকে ফিরাউনের চাইতেও নির্লজ্জভাবে বিদায় নিতে হয়েছে। তাদের এমন রাজনীতি বড় লজ্জার!। আওয়ামী লীগের দোসররা এখন বুঝতে পারছে জনগণের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে কেউ পার পায় না। এ সরকার ক্ষমতায় এসে ১৮ কোটি মানুষের উপর তা-ব চালিয়েছিল। তারা প্রথমে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে দুর্বল করেছে, পরে জামায়াতে ইসলামীর ওপর অবর্ণনীয় জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছে এবং শেষও করেছিল জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করে। তারা জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে বিচারের নামে প্রহসন করে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেছে। সবশেষে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু তারাই জনগণ কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। তিনি সমাবেশে আগত জনগণের কাছে জানতে চান, আপনারাই বলেন, কারা নিষিদ্ধ হয়েছে? সমস্বরে জবাব আসে আওয়ামী লীগই নিষিদ্ধ হয়েছে। জালিম সরকারের দোসররা দুপুরের খাবারের টেবিল থেকে বাপ-বেটাকে ধরে নিয়ে বলেছিল, এরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিল। এমন হাজারো ঘটনার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিজমের মাত্রা চরমভাবে অতিক্রম করেছিল।
সম্মানিত ভাইয়েরা ফ্যাসিস্টদের পতন হয়েছে ঠিকই, ফ্যাসিজম এখনোও বিদায় নেয়নি। আমরা ফ্যাসিস্ট ও ফ্যাসিজমেরও পতন চাই। রাজনৈতিক কর্মী নামের যারা কলঙ্ক, তাদের হাতে এখনো দেশের মানুষ নির্যাতিত হচ্ছে। রাস্তা-ঘাটে, পথে-প্রান্তরে, শহরে-বন্দরে, ফুটপাতে, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে, শিল্পকারাখানায়, পরিবহন সেক্টরে, টেম্পু ও বাসস্ট্যান্ড-এ ভয়াবহ চাঁদাবাজের তান্ডবে দেশের মানুষ অতিষ্ঠ। জনগণের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছে; তারা ইতোমধ্যেই এইসব চাঁদাবাজ ও দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। আমরা তাদেরকে অভিনন্দন জানাই। আমরা দেশের জনগণকে আশ্বস্ত করছি যে, এইসব চাঁদাবাজ ও দখলদারদের বিরুদ্ধে আমরা একসঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তুলব ইনশাআল্লাহ।
তিনি আরও বলেন, দেশের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এমন রাষ্ট্রের জন্য একদল সৎ মানুষ প্রয়োজন। জামায়াতে ইসলামী তার প্রতিষ্ঠার পর থেকে একদল সৎ, দেশপ্রেমিক ও যোগ্য লোক তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ২০০১-২০০৬ সালে জামায়াতের দুইজন মন্ত্রী ৩টি মন্ত্রণালয় পরিচালনা করেছেন; কিন্তু হাজারো চেষ্টা করেও তাদের বিরুদ্ধে কেউ এক টাকার দুর্নীতিও প্রমাণ করতে পারেনি। তারা শুধু সৎ-ই ছিলেন না, স্মার্ট ও যোগ্যও ছিলেন। এতে বুঝা যায় জামায়াত দেশের সকল মন্ত্রণালয়ই অত্যন্ত দক্ষতা ও সততার সাথে পরিচালনা করতে পারবে, ইনশাআল্লাহ। শুধু মন্ত্রীদেরকেই নয়, কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও সৎ ও যোগ্য হতে হবে। মন্ত্রীগণ যদি সৎ হন, তাহলে তার অধিনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীগণও সৎ হতে বাধ্য। সৎ মন্ত্রীর অধিনস্থরা ঘুষ-দুর্নীতি করতে একবার হলেও চিন্তা করতে বাধ্য হবেন। পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্মানের দিকেও রাষ্ট্রকে নজর দিতে হবে। তাদের সম্মানজনক বেতন দিতে হবে; যাতে তারা দেশের জন্য নিজেদের জানপ্রাণ উজার করে দিয়ে কাজ করতে পারেন। একজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে যদি উপযুক্ত বেতন-ভাতা দেওয়া না হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে রাষ্ট্রই তাকে দুর্নীতি করতে বাধ্য করছে। এই উপলব্ধি থেকেই জামায়াতে ইসলামী এমন একটি বাংলাদেশ গড়তে চায়, যেখানে সকল সেক্টরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপযুক্ত বেতন ভাতা দিয়ে সম্মানের সাথে বাঁচতে সহযোগিতা করা হবে।
তিনি তরুণ সমাজের উদ্দেশে বলেন, আমরা দেশের তরুণ-তরুণী এবং যুবক-যুবতীদের নিয়ে বিশেষভাবে স্বপ্ন দেখি; যাদের হাতে আমরা আগামীর বাংলাদেশ তুলে দিতে চাই। আমরা তাদের জন্য এমন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই, যেই শিক্ষাব্যবস্থা তাদেরকে সম্মানের সাথে বাঁচতে শেখাবে। যেই শিক্ষাব্যবস্থা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেবে, তাদের এ অবস্থায় আসার পেছনে রাস্তার একজন ঝাড়–দারেরও অবদান রয়েছে। আজকে তাদের এই অবদানের ফসল তোমাদের মেধার বিকাশ। এতএব, তাদের এই ঋণ তোমাকে পরিশোধ করতে হবে।
তিনি বলেন, বর্তমান শিক্ষায় শিক্ষিতরা নিজেদেরকে রাজা এবং জনগণকে প্রজা মনে করে। এই মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। আমরা এমন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলব তাতে তারা শুধু নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হবেন না; বৈষয়িক শিক্ষায়ও চরম উৎকর্ষ সাধন করবেন। শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার সাথে সাথে রাষ্ট্র তাদের হাতে কাজ তুলে দেবে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় দেশের তরুণ-তরুণীরা সার্টিফিকেটের বস্তা বগলদাগা করে এক অফিস থেকে অন্য অফিসে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে শেষ পর্যন্ত চাকরি না পেয়ে আত্মহত্যার পথ বেঁছে নেয়। আমরা এমন চিত্র আর বাংলাদেশে দেখতে চাই না।
তিনি কৃষকদের উদ্দেশে বলেন, আমরা প্রত্যেকটি নাগরিকের হাতকে কারিগরের হাত হিসেবে গড়তে চাই। একজন কৃষক আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফসল ফলাবেন। পরিশ্রম হবে সহনীয়, উৎপাদন হবে অভাবনীয়। ফসলের মার্কেট প্রাইস নিশ্চিত করে তাদের উৎসাহিত করা হবে। মৌসুমী ফসল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে মৌসুমী শাক-সবজ, ফল-ফলাদি পঁচে নষ্ট না হয় এবং অন্য মৌসুমে সরবরাহ করে সুষ্ঠু বাজারব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়।
তিনি নারী সমাজকে লক্ষ্য করে বলেন, এদেশের অর্ধেক জনশক্তি নারী। তাদের হাতকেও দক্ষ কারিগরের হাতে রূপান্তরিত করা হবে। শিক্ষিত নারীদেরকে নিজ নিজ যোগ্যতানুযায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে; তাদের সম্মানজনক কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা হবে। গত ৫৪ বছরেও নারীদের সম্মানজনক সামাজিক পরিবেশ এবং মান-মর্যাদা নিশ্চিত করা হয়নি। আগামীতে তাদের জন্য এমন পরিবেশ নিশ্চিত করা হবে, যেখানে সম্মান ও মর্যাদা দুটোই পাবেন। অনেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বলেন, জামায়াত ক্ষমতায় গেলে মহিলাদের কর্মে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। আল্লাহর হাবিব রাসূল (সা.) নিজ পরিবারসহ নারীদের যুদ্ধের মতো কঠিন কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। আমরা বলতে চাই, মহিলারা যদি যোদ্ধা হতে পারে, তবে সমাজের কোন কাজটি তারা করতে পারবে না? বর্তমান সমাজে অভিভাবকগণ চিন্তায় অস্থির থাকেন যে, পরিবারের মা-বোন ও মেয়েরা মান-সম্মান এবং ইজ্জত নিয়ে ঘরে ফিরতে পারবে কিনা? আমি দেশবাসীর উদ্দেশে আবারও বলতে চাই যে, সমাজের সকল ক্ষেত্রে মহিলাদের সম্মান, মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। রাসূল (সা.) বলেছেন, এমন একটি সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে যেখানে একজন নারী একাকী সানা থেকে হাজরা মাওত পর্যন্ত ভ্রমণ করবে, কিন্তু একজন জালিমও তার দিকে চোখ তুলে তাকাবার দুঃসাহস করবে না। তিনি সকলের উদ্দেশে বলেন, কুরআনের এই নিরাপত্তাবলয় থেকে অত্যন্ত সুকৌশলে ষড়যন্ত্র করে এদেশের মানুষকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে।
একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী ভাই স্লিপ দিয়ে আমীরে জামায়াতকে অনুরোধ করে বলেন, সরকার যেন তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে নতুন আইন পাশ করে। আমীরে জামায়াত তাকে নিশ্চিয়তা প্রদান করে বলেন, জামায়াত রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সকল নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করা হবে। কথায় নয়, কাজে আমরা তা প্রমাণ করব ইনশাআল্লাহ। আমাদের অতীত এবং বর্তমান কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে দেখুন বিপদাপদে আপনারা সবসময় আমাদের পাশে পেয়েছেন, পাচ্ছেন এবং ভব্যিতেও পাবেন আশা করি। তার উদাহরণ আপনারা দেখেছেন ৫ আগষ্টের পট-পরিবর্তণের পর। আমরা বুঝতে সক্ষম হয়েছিলাম দুষ্কৃতিকারীরা সুযোগ নিতে পারে। তাই আমরা জাতির জন্য চৌকিদারের মত পাহারাদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। আমরা একাধারে ১৫ দিন সকল সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উপাসনালয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি। আমরা আগামীতে এমন একটা দেশ নির্মাণ করতে চাই, যেখানে মসজিদ যেমন পাহারা দিতে হবে না, তেমনি কোনো মন্দির, চার্চ এবং মটও পাহারা দিতে হবে না। সমাজ এবং সরকার এসবের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
তিনি আরও বলেন, বিগত ৫৪ বছরে সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু ধুয়া তুলে জাতিকে বিভক্ত করে দুর্বল করে রাখা হয়েছে। আমাদেরকে মুখামুখী করে রাখা হয়েছিল। যারা সংখ্যালঘু বলে মায়াকান্না করেন, গত ফ্যাসিস্ট আমলে রংপুরের মৎস্য পল্লীতে, দিনাজপুরের সাঁওতাল পল্লীতে, বি-বাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু পল্লীতে কারা হামলা চালিয়েছিল, কারা লুটপাট করেছিল, ভাঙচুর করেছিল, অগ্নিসংযোগ করেছিল, কারা গরু-ছাগল চুরি করেছিল, তা আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখুন। আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে চাই, যারাই সংখ্যালঘুদের নিয়ে মায়াকান্না করে, তারাই এই অপকর্মগুলো করে আমাদের ওপর দোষ চাপানোর অপচেষ্টা চালিয়েছিল। আমরা আল্লাহকে ভয় করে চলি। আর যারা আল্লাহকে ভয় করে চলে তাদের হাতে মানুষের জীবন, সম্পদ ও ইজ্জত নিরাপদ। আমরা জাতিকে বিভক্তকারী সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু শব্দই আর শুনতে চাই না। আমরা পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, যারা এদেশে জন্মগ্রহণ করেছে এবং যারা এখানে বসবাস করছেন তারা সকলেই এদেশের মর্যাদান, গর্বিত নাগরিক। আমাদের সরকার ও সংবিধান সকলের অধিকার নিশ্চিত করতে বাধ্য। পবিত্র কুরআন শরীফে আল্লাহ নির্দেশ দিচ্ছে যে,‘ তোমরা সমাজে ন্যায় বিচার কায়েম করো এবং মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শণ করো।’ এই ঘোষণার ভিত্তিতে আমরা সমাজে সৎ লোকের শাসন কায়েম করতে চাই।
তিনি বলেন, আমরা দেখতে চাই যে, দেশ থেকে ফ্যাসিবাদীরা নির্মূল হয়েছে এবং দেশ ফ্যাসিবাদ মুক্ত হয়েছে। দুঃখজনকভাবে ফ্যাসিবাদ আমলে গ্রেফতার হওয়া উত্তর জনপদের প্রিয় নেতা কলিজার টুকরো এটিএম আজহারুল ইসলাম এখনো বন্দি কেন, জনগণ তা জানতে চায়। কবে তিনি মুক্ত হবেন জনগণ তা শুনতে চায়। আমরা অনুরোধ করছি তার মুক্তির ব্যাপারে কেউ ধানাই-পিনাই করবেন না। সম্মানের সাথে তাকে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দিন। মুক্তি দিয়ে তাঁকে দেশগড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করার সুযোগ দিন। আমরা এখনো রংপুরে বড় কোনো সমাবেশ করি নাই। আশা করছি অচিরেই আমরা আমাদের প্রিয় ভাই এটিএম আজহারুল ইসলামকে সাথে নিয়ে রংপুরে বড় জনসমাবেশ করব, ইনশাআল্লাহ। মহান রব! আমাদের মজলুম ভাইসহ আমাদেরকে কবুল করুন।
কিছু দিন আগে এই অঞ্চলের এক ভাই হাসিনুর রহমানকে বিএসএফ নির্মমভাবে বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করে তার লাশ টেনে হিঁচড়ে ওপাড়ে নিয়ে গিয়েছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছি। আমরা বিবেকবান মানুষের কাছে জিজ্ঞাসা করতে চাই, সে কী মানুষ ছিল না! আমাদের বিজিবি ভাইয়েরা কী কখনো এভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ওপাড়ের কাউকে হত্যা করেছে? না, করেনি। কারণ আমরা সকল দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে জানি। আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি তারাও সম্মান প্রদর্শন করবে এটাই আমরা আশা করি। গত ৫৪ বছর যাবৎ আমাদেরকে দাবিয়ে রাখা হয়েছে। এ কালো ছায়া আর আমরা দেখতে চাই। আমরা একে অপরের অধিকার সুরক্ষিত দেখতে চাই।
তিনি বলেন, লালমনিরহাটবাসীর পক্ষ থেকে কিছু দাবি পেশ করা হয়েছে। বর্ষা মওসুম আসলেই তিস্তাপারের মানুষ আতঙ্কে থাকেন। কখন জানি ওপাড়ের বন্যা এসে আমাদের সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আমরা আর এই আতঙ্কে থাকতে চাই না। যেকোনো মূল্যে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন দেখতে চাই। কোনো ধরনের চক্রান্তে যেন এই মহাপরিকল্পনা ভেস্তে না যায়। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমরা কোনো ধরনের চক্রান্ত বরদাশত করব না। অবিলম্বে এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।
দ্বিতীয়তঃ বৃটিশ আমলে নির্মিত বিমানবন্দর আজ অবহেলায় পড়ে আছে, অবিলম্বে তা চালু করতে হবে। এখানকার এ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটি টেম্পোরারী ক্যাম্পাসে চলছে। আমরা শুনতে পেয়েছি তা অন্যত্র সরিয়ে নেবার চক্রান্ত হচ্ছে। এটা কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না। বরং এখানে স্থায়ী ক্যাম্পাস গড়ে তুলতে হবে। এই অঞ্চল কৃষিপ্রধান হওয়ায় এখানে এ্যাগ্রোবেসড শিল্পকারখানা এবং এ্যাগ্রো-ইউনিভার্সিটি গড়ে তুলতে হবে। যাতে এই অঞ্চলের মানুষ মেধার বিকাশের পাশাপাশি আধুনিক কৃষিনির্ভর জ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যাপক ভিত্তিক ফসল ফলাতে পারে। দক্ষতা অর্জন করে দেশ ও জাতির সেবা করতে পারে। আমাদের দাবি এখানে একটি মেডিকেল কলেজ নির্মাণ করা হোক। তা না হলে কমপক্ষে এখানে একটি আধুনিক হাসপাতাল থাকতেই হবে। মানুষের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারসহ চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিতদের এখানকার কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে যাতে তারা আন্তরিকতার সাথে তাদের সেবা চালিয়ে যেতে পারেন।
Discussion about this post