বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা: শফিকুর রহমান বলেছেন, ভাষার অধিকার কেড়ে নেয়ার কারনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে শুধু প্রতিবাদই নয়, প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল এবং অধিকার আদায় করেছিল। একটি মাত্র অধিকার কেড়ে নেয়ার কারনে আমরা লড়াই করে বিজয়ী হয়েছিলাম। কিন্তু আজ আমরা সব অধিকারহারা। মানুষের জীবন, সম্মান, মেধা, ভোটাধিকার, বাক স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছে। তিনি জনগনের অধিকার ফিরিয়ে দিতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহবান জানিয়ে বলেন, সব ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজপথে নামুন। দাবী আদায় হবে, ইনশাআল্লাহ। এই অপশাসনের অবসান হবে। রাত দূরে হয়ে সকাল হবে। মুক্তির সূর্য উদিত হবে।
আজ রোববার রোববার রাজধানীর এক মিয়নায়তনে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস ও শহীদ দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের উদ্যোগে আয়োজিত আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমীর নূরুল ইসলাম বুলবুলের সভাপতিত্বে সহকারী সেক্রেটারি এডভোকেট ড. হেলাল উদ্দিনের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সভায় আরো বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও মহানগরী দক্ষিণের নায়েবে আমীর মঞ্জুরুল ইসলাম ভূইয়া, সহকারী সেক্রেটারি আবদুল জব্বার, মহানগরীর কর্মপরিষদ সদস্য আবদুস সবুর ফকির। আরও উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরা সদস্য ও মহানগরীর কর্মপরিষদ সদস্য মোকাররম হোসাইন, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের মজলিশে শুরা সদস্য সৈয়দ সিরাজুল হক, আব্দুস সাত্তার সুমন, আশরাফুল আলম ইমন প্রমূখ।
বক্তব্যের শুরুতে ডা.শফিকুর রহমান ৫২ ভাষা আন্দোলনে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন তাদের শহীদ হিসেবে কবুল করার জন্য দোয়া করেন এবং এই আন্দোলন সফল করার জন্য যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করেছে তাদের সবাইকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন।
জামায়াত আমীর বলেন, ভাষা আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর প্রফেসর অধ্যাপক গোলাম আযম এর বিশাল অবদান থাকা সত্তেও একটি মহল তার নাম নিশানা মুখে ফেলার চেষ্টা করছে। তারা হয়তো কাগজে কলমে তার নাম মুছে ফেলতে পারবে, কিন্তু মানুষের হৃদয় থেকে কখনই মুছতে পারবে না। ভাষা আন্দোলনের নেতা হিসেবে তাকে রাষ্ট্রীয় ভাবে মর্যাদা দেয়া না হলেও তাঁর বিদায়টা ছিল বর্ণিল। তাঁর নামাজে জানাযা একটি ইতিহাস হয়ে থাকবে। আসলে ইতিহাস থেকে কাউকে মুছে ফেলা যায় না। আমরা আশা করছি, বাংলার ইতিহাস একটি আসল ঠিকানায় পৌছবে।
ডা: শফিকুর রহমান বলেন, বাংলা ভাষার জন্য লড়াই, সংগ্রাম, জীবন দানের ঘটনার তারিখ আমরা অন্য ভাষায় পালন করে থাকি। এটা সবচেয়ে ভালো হতো, যদি ২১ শে ফেব্রয়ারি না হয়ে ৮ ফাল্গুন উদযাপন করা যেতো। তিনি বলেন, ৩২ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। আমাদের কেন হীনমন্যতা থাকবে? কেন আমরা বাংলাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারিনি। আদালতে অনেকে বিচার প্রার্থী হন, যারা ইংরেজী ভাষা বুঝেন না। তার মামলার রায় বুঝার জন্য অন্যের দ্বারস্ত হতে হয়। তিনি তার্কিশ, জার্মানিসহ বিভিন্ন ভাষার উদাহরণ দিয়ে বলেন, তারা স্ব স্ব ভাষা চর্চা করে বিশ্বের সাথে টেক্কা দিয়ে চলছে। কিন্তু আমরা নিজ ভাষা নিয়ে বিশ্বের কাছে দাড়াতে পারছি না। তিনি সব ধরনের হীনমন্যতা দূর করে আপন সত্তা বিকশিত করে সামনে এগিয়ে চলার আহবান জানান। তিনি বলেন, ভাষা আল্লাহর দান। আমরা অন্য ভাষা রপ্ত করবো। কিন্তু সবাইকে পন্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। নিজ ভাষায় আমরা পান্ডিত্য অর্জন করবো।
জামায়াত আমীর ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বর্ননা করতে গিয়ে বলেন, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে ৩ টি প্রদেশের মধ্যে জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৪ কোটি। আর ১টি প্রদেশ নিয়ে গঠিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। উর্দু শুধুমাত্র ১টি প্রদেশের ভাষা ছিল। সেই ভাষাকে গোটা পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার কারনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে শুধু প্রতিবাদই নয়, প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল এবং অধিকার আদায় করেছিল। একটি মাত্র অধিকার কেড়ে নেয়ার কারনে আমরা লড়াই করে বিজয়ী হয়েছিলাম।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আজ আমরা সব অধিকারহারা। মানুষের জীবন, সম্মান, মেধা, ভোটাধিকার, বাক স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছে। এ অবস্থা মেনে নেয়া যায়? তাহলে ইতিহাস থেকে আমরা কি শিক্ষা নিলাম? যারা অধিকার আদায় করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন, তাদের থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
তিনি বলেন, এখন সার্বজনীন অধিকার হরনের চেষ্টা করা হচ্ছে। তা মেনে নেয়া যায় না। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করে জনগনের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। এজন্য মজলুম জনগনকে পাশে চাই। তিনি উল্লেখ করেন, অধিকার কেউ কাউকে দেয় না। লড়াই করে অধিকার আদায় করে আনতে হবে। এজন্য বুকে সাহস থাকতে হয়। আমাদের নেতৃবৃন্দ সেই সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তারা অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি। তাদের নাম স্বর্ণের অক্ষরে লেখা হয়ে গেছে। কেউ তা মুছতে পারবে না। তিনি উল্লেখ করেন, মুসলমানরা সম্মানের জাতি। তারা আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথা নত করে না।
তিনি দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বলেন, শহীদের রক্তের প্রতি কৃতজ্ঞতার দাবী হচ্ছে, সব ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজপথে নামুন। দাবী আদায় হবে, ইনশাআল্লাহ। এই অপশাসনের অবসান হবে। রাত দূরে হয়ে সকাল হবে। মুক্তির সূর্য উদিত হবে।
সভাপতির বক্তব্যে নূরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, গোটা দুনিয়ায় ভাষা আন্দোলনের নজির নেই। যেখানে নিজের জীবন দিয়ে, রক্ত দিয়ে অধিকার আদায় করেছে। এদেশের জনগন মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, আইন আদালত, সরকারী প্রতিষ্ঠানসহ সর্বস্তরে এখনো বাংলা ভাষার ব্যবহার হচ্ছে না।
মহানগরী আমীর বলেন, ভাষা আন্দোলনে ডাকসুর তৎকালীন জিএস অধ্যাপক গোলাম আযম, তমদ্দুন মজলিসের অবদান এখন স্মরণ করা হয় না। কিন্তু ইতিহাস থেকে কাউকে মুছে ফেলা যায় না। কোন দেশ কখনো উন্নত হতে পারে না, যখন তারা গুনিজনকে সম্মান না করে। তিনি বলেন, ৫২ ভাষা আন্দোলনের মধ্যে স্বাধীনতার বীজ বপন করা হয়েছিল। যারা ধারাবাহিকতায় দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু গনতান্ত্রিক এই দেশে মানুষের সব অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায়, ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠায়, জনগনের রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠায় দলমত নির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
মঞ্জুরুল ইসলাম ভূইয়া বলেন, অফিস আদালতে এখনও আমরা মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। ভাষাকে সর্বস্তরে কার্যকর ভাবে ব্যবহার করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে রফিক, সালাম, আবদুল জাব্বারের শহীদ হওয়া স্বার্থক হবে। তিনি বলেন, আমরা এখনও দলীয় সংকীনতার উর্ধ্বে উঠে মানুষকে মূল্যায়ন করতে পারি না। ভাষা আন্দোলনের আলোচনা হয়, কিন্তু ভাষা আন্দোলনের নেতা প্রফেসর গোলাম আযমের নাম আসে না। তিনি প্রশস্ত হৃদয় নিয়ে যথার্থ অবদানের মূল্যায়ন করার আহবান জানান।
আলোচনা সভা শেষে জামায়াতের আমীর ভাষা শহীদদের স্মরণে, দেশ ও জাতির জন্য দোয়া ও মুনাজাত করেন।